গাঁজার চোরাচালান নেটওয়ার্কের গোপন সাম্রাজ্য

সীমান্তের ছায়া-রাস্তায়: গাঁজার চোরাচালান নেটওয়ার্কের গোপন সাম্রাজ্যনির্বাহী সারসংক্ষেপএই প্রতিবেদন বাংলাদেশে গাঁজা চোরাচালান নেটওয়ার্কের ব্যাপকতা এবং এর জটিল প্রকৃতি উন্মোচন করেছে। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মাদক উৎপাদন অঞ্চলের কেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় এটি মাদক পাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে। এই নেটওয়ার্কগুলির কাঠামো অত্যন্ত জটিল, যেখানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ জড়িত, যার মধ্যে কর্মসংস্থানহীন দরিদ্র ব্যক্তি, রাজনৈতিক দলের কর্মী, এমনকি গৃহবধূ ও কিশোরীরাও রয়েছে। চোরাচালানকারীরা তাদের কার্যক্রমে অত্যাধুনিক কৌশল, যেমন – গোপন পরিবহন পদ্ধতি এবং অনানুষ্ঠানিক আর্থিক লেনদেন ব্যবহার করে। দেশের সীমান্ত জুড়ে অসংখ্য প্রবেশপথ চিহ্নিত করা হয়েছে, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নিয়মিত অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ গাঁজা এবং অন্যান্য মাদকদ্রব্য জব্দ করছে এবং অসংখ্য অপরাধীকে গ্রেপ্তার করছে। তবে, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতির অভিযোগ এবং আন্তঃসংস্থা সমন্বয়হীনতা এই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে। মাদক ব্যবসার উচ্চ মুনাফা এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলের দারিদ্র্য নতুন নতুন ব্যক্তিদের এই অবৈধ কার্যক্রমে যুক্ত হতে উৎসাহিত করে। এই প্রতিবেদনটি একটি সমন্বিত এবং বহু-মাত্রিক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়, যেখানে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দুর্নীতি দমন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা গেলে বাংলাদেশের মাদকমুক্ত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব।১. ভূমিকা: গাঁজা চোরাচালানের ছায়া-পথ উন্মোচন১.১ ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশের ট্রানজিট হাব হিসেবে দুর্বলতাবাংলাদেশ, নিজে কোনো বড় মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও, ভৌগোলিকভাবে এমন এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে যা এটিকে আন্তর্জাতিক মাদক পাচারের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এটি তিনটি কুখ্যাত মাদক উৎপাদন ও পাচার অঞ্চলের কেন্দ্রে অবস্থিত: পূর্বে ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ (মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস), পশ্চিমে ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ (পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান) এবং উত্তরে ‘গোল্ডেন ওয়েজ’ (ভারতের হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, নেপাল এবং ভুটানের কিছু অংশ) 1। এই অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান আন্তর্জাতিক মাদক চক্রকে বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের মাদক, যার মধ্যে গাঁজাও রয়েছে, পাচারের জন্য একটি সহজ ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করতে সহায়তা করে 2।এই অঞ্চলগুলির সংমিশ্রণ বাংলাদেশকে কেবল একটি ভোক্তা বাজার থেকে আন্তর্জাতিক মাদক কার্টেলগুলির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট করিডোরে রূপান্তরিত করেছে। এর অর্থ হলো, অভ্যন্তরীণ মাদকবিরোধী প্রচেষ্টা, যদিও অপরিহার্য, তা অবশ্যই শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে পরিপূরক হতে হবে যাতে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা উৎস এবং ট্রানজিট পয়েন্টগুলিতে সমস্যা মোকাবিলা করা যায়। ২০১৭ সালে উদ্ধারকৃত ৬৯,৯৮৯ কেজি গাঁজার মতো বিশাল পরিমাণ মাদক অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের চেয়েও বেশি ট্রানজিট ভূমিকার ইঙ্গিত দেয় 1।১.২ বাংলাদেশের অবৈধ মাদক ব্যবসায় গাঁজার গুরুত্বইয়াবা, কোডিন সিরাপ (ফেনসিডিল), আইস এবং হেরোইনের পাশাপাশি গাঁজা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রচলিত মাদক 4। ইয়াবা এবং আইস নতুন হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হলেও 2, গাঁজা তার উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি বজায় রেখেছে এবং প্রায়শই বড় পরিমাণে পাচার হয়। ২০১৭ সালে ৬৯,৯৮৯ কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছিল 1, এবং একই বছর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ১৬,৩৫৭ কেজি গাঁজা জব্দ করে 5। সম্প্রতি ঢাকার খিলক্ষেত এলাকা থেকে ১০২ কেজি গাঁজা জব্দ করা হয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ২০ লাখ ৪০ হাজার টাকা 6।বিভিন্ন অভিযানে গাঁজার ধারাবাহিক উদ্ধার (যেমন – দিনাজপুর অঞ্চলে ২০১৮ সালের জুনে ৮০৬টি অভিযানে গাঁজা জব্দ 7, ২০১৯ সালের আগস্টে পুলিশ কর্তৃক ৮ কেজি ৬২৫ গ্রাম গাঁজা জব্দ 8, বিএসএফ কর্তৃক মালদা সেক্টরে ১ কেজি গাঁজা উদ্ধার 9) এর ক্রমাগত সহজলভ্যতা এবং এর পাচারে জড়িত সক্রিয় নেটওয়ার্কগুলির উপস্থিতি প্রমাণ করে। সিন্থেটিক ড্রাগ যেমন ইয়াবা এবং আইসের উদ্বেগ বাড়লেও গাঁজার ধারাবাহিক বৃহৎ আকারের জব্দ নির্দেশ করে যে গাঁজা চোরাচালান একটি কমতে থাকা সমস্যা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের অবৈধ মাদক অর্থনীতির একটি গভীরভাবে প্রোথিত, মৌলিক উপাদান। এর থেকে বোঝা যায় যে নতুন হুমকির দিকে মনোযোগ দিলেও, গাঁজার মতো ঐতিহ্যবাহী মাদক মোকাবিলা থেকে সম্পদ সরিয়ে নেওয়া উচিত নয়, কারণ এর নেটওয়ার্কগুলি অন্যান্য মাদকের জন্য লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করতে পারে। গাঁজার বিশাল পরিমাণ জব্দ একটি শক্তিশালী, প্রতিষ্ঠিত সরবরাহ শৃঙ্খলের ইঙ্গিত দেয় যা আইন প্রয়োগকারী প্রচেষ্টার প্রতি স্থিতিস্থাপক। এই নেটওয়ার্কের দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং স্কেল অন্যান্য মাদকের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সক্ষমতা বা এমনকি একটি বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। অতএব, গাঁজা চোরাচালান মোকাবিলা কেবল গাঁজা নিয়েই নয়, বরং সামগ্রিক মাদক ব্যবসার অবকাঠামোর একটি মৌলিক স্তম্ভ ভেঙে ফেলার বিষয়েও।১.৩ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য, পরিধি এবং পদ্ধতিএই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের গাঁজা চোরাচালান নেটওয়ার্কগুলির একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রদান করতে চায়, তাদের কাঠামো, কার্যপ্রণালী, প্রধান রুট এবং যে সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গতিশীলতা তাদের টিকিয়ে রাখে, তা পরীক্ষা করে। এটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলিও মূল্যায়ন করবে এবং কার্যকর নীতিগত সুপারিশ প্রস্তাব করবে। বিশ্লেষণটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন, সরকারি নথি এবং সাংবাদিকতামূলক তথ্যের (গবেষণা উপাদান হিসেবে প্রদত্ত) পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। পদ্ধতিগতভাবে, এটি গুণগত ও পরিমাণগত ডেটা সংশ্লেষণ করে নিদর্শন, কার্যকারণ সম্পর্ক এবং বৃহত্তর প্রভাবগুলি চিহ্নিত করে।২. গাঁজা চোরাচালান নেটওয়ার্কের গঠন ও কার্যপ্রণালী২.১ মূল অভিনেতা এবং তাদের ভূমিকামাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) একটি জরিপে গাঁজাসহ মাদক পাচারে জড়িত অভিনেতাদের একটি জটিল জাল উন্মোচিত হয়েছে। জরিপে উত্তরদাতাদের ৪১ শতাংশ স্থানীয় কর্মসংস্থানহীন দরিদ্র ব্যক্তিদের জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করেছেন 4। এই ব্যক্তিরা প্রায়শই বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাব এবং দ্রুত, প্রচুর অবৈধ আয়ের আশায় এই ব্যবসায় আকৃষ্ট হন 4।প্রায় ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, রাজনৈতিক দলের কর্মীরা এই পাচারে জড়িত এবং তারা নিজেদের সেই পরিচয় ব্যবহার করে 4। এটি তাদের কার্যক্রমে এক ধরনের সুরক্ষা বা প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আল মনসুরকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, যিনি পেশায় সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী হলেও মাদকের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন 4। জরিপে ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থীও মাদক পাচারে জড়িত বলে ধারণা করা হয় 4।এছাড়াও, গৃহবধূ ও কিশোরীদের বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যারা বিশেষ পোশাকের ভেতরে ছোট ছোট প্যাকেট লুকিয়ে সীমান্ত থেকে মাদক নিয়ে আসে 10। স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ীরা বিকাশের মতো মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবার মাধ্যমে ভারতে টাকা পাঠিয়ে পাচারকারীদের আর্থিক সহায়তা করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে 11।এই বিস্তৃত জনতাত্ত্বিক সম্পৃক্ততা (কর্মসংস্থানহীন দরিদ্র, রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষার্থী, গৃহবধূ, কিশোর-কিশোরী) একটি অত্যন্ত অভিযোজনক্ষম এবং সুযোগসন্ধানী নেটওয়ার্ক কাঠামোর দিকে নির্দেশ করে যা সামাজিক-অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগায়। রাজনৈতিক কর্মীদের জড়িত থাকা এবং তাদের “ছত্রছায়া” প্রদানের ধারণা 4 একটি পদ্ধতিগত দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয় যা আইন প্রয়োগকারী প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে, এমন একটি “ছায়া সাম্রাজ্য” তৈরি করে যেখানে অবৈধ কার্যক্রম সুরক্ষিত থাকে। এর অর্থ হলো, মাদক চোরাচালান মোকাবিলায় কেবল আইন প্রয়োগই নয়, বরং সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দুর্নীতি দমন ব্যবস্থাও প্রয়োজন।২.২ কার্যপ্রণালীচোরাচালানকারীরা গাঁজা এবং অন্যান্য মাদক সীমান্ত পেরিয়ে পরিবহনের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে। মানব বাহক, যার মধ্যে গৃহবধূ ও কিশোরীরাও রয়েছে, বিশেষ পোশাকের ভেতরে মাদকের ছোট ছোট প্যাকেট লুকিয়ে রাখে 10। ফেনসিডিলের মতো মাদকের জন্য চোরাচালানকারীরা খালে বাঁশের ভেলা তৈরি করে তার নিচে বোতল বেঁধে ভাসিয়ে দেয়, যা পরে নির্দিষ্ট স্থানে তুলে নেওয়া হয় 10। এই পদ্ধতি গাঁজার ক্ষেত্রেও অভিযোজিত হতে পারে।বাহকরা “সুবিধাজনক সময়ে” মাদক সংগ্রহ করে 10, যা টহল এড়ানোর জন্য সুযোগসন্ধানী সময় নির্বাচনের ইঙ্গিত দেয়। চোরাচালানকারীরা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চোখ এড়াতে অন্ধকারের সুযোগও নেয় 9। যদিও গাঁজার জন্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি, রেলওয়ে স্টেশনযুক্ত উপজেলাগুলিতে রেলপথে মাদকবিরোধী অভিযান বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে, যা মাদক এবং সাধারণ চোরাচালানের জন্য রেললাইন ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয় 8।চোরাচালানের পদ্ধতিগুলির অভিযোজন ক্ষমতা এবং কম প্রযুক্তির উদ্ভাবনী ক্ষমতা (যেমন – বাঁশের ভেলা, বিশেষ পোশাক, অন্ধকারের সুযোগ নেওয়া) প্রচলিত সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে এই নেটওয়ার্কগুলির চতুরতাকে তুলে ধরে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে শুধুমাত্র উচ্চ প্রযুক্তির নজরদারির উপর নির্ভর করা অপর্যাপ্ত হতে পারে; মানব গোয়েন্দা, কমিউনিটি এনগেজমেন্ট এবং অভিযোজনক্ষম পাল্টা কৌশলের সমন্বয়ে একটি বহু-স্তরীয় পদ্ধতির প্রয়োজন।২.৩ আর্থিক প্রক্রিয়াঅবৈধ মাদক ব্যবসা, যার মধ্যে গাঁজাও রয়েছে, প্রচুর অবৈধ মুনাফা এনে দেয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি জরিপ অনুসারে, সীমান্তে খুব কম দামে কেনা মাদক দেশের অভ্যন্তরে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি দামে বিক্রি হয়। উদাহরণস্বরূপ, মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় একটি ইয়াবা বড়ি যে দামে কেনাবেচা হয়, স্থানীয় উপজেলা সদরে তার প্রায় তিন গুণ, জেলা শহরে পাঁচ গুণ এবং রাজধানীসহ অন্যান্য জেলায় কখনো কখনো সীমান্তের ১০ গুণ পর্যন্ত দাম ওঠে 4। এই বিশাল মুনাফার প্রলোভনই বিশেষ করে কর্মসংস্থানহীন দরিদ্র ব্যক্তিদের এই ব্যবসায় জড়িত হওয়ার প্রধান কারণ 4।স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ীরা বিকাশের মতো মোবাইল আর্থিক পরিষেবার মাধ্যমে ভারতে টাকা পাঠিয়ে চোরাচালানকারীদের আন্তঃসীমান্ত আর্থিক লেনদেনে সহায়তা করে 11। মাদকের অর্থের বেশিরভাগ লেনদেন “হুন্ডি”র মতো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে হয়, যা অর্থ পাচারের সুযোগ তৈরি করে 12।এই উচ্চ লাভজনকতা, বিকাশের মতো অনানুষ্ঠানিক আর্থিক চ্যানেল এবং হুন্ডির ব্যবহার এই নেটওয়ার্কগুলির জন্য একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ইঞ্জিন তৈরি করে, যা নিম্ন-স্তরের অপারেটরদের গ্রেপ্তারের পরেও তাদের স্থিতিস্থাপক করে তোলে। অবৈধ আর্থিক স্থানান্তরের সহজলভ্যতা আর্থিক ব্যবস্থার একটি গুরুতর দুর্বলতাকে তুলে ধরে যা এই “গোপন সাম্রাজ্য”কে বিকশিত হতে সাহায্য করে। শুধুমাত্র মাদক জব্দ করার উপর মনোযোগ না দিয়ে, অর্থ পাচার আইন প্রয়োগ এবং মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই আর্থিক প্রবাহগুলিকে ব্যাহত করা আরও কার্যকর হতে পারে। এর মাধ্যমে “গডফাদারদের” আর্থিক মেরুদণ্ডে আঘাত হানা সম্ভব হবে।৩. গাঁজা চোরাচালানের রুট এবং চিহ্নিত হটস্পট৩.১ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রুটগাঁজাসহ মাদকদ্রব্য মূলত প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে 1। ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ (মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস), ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ (পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান) এবং ‘গোল্ডেন ওয়েজ’ (ভারতের কিছু অংশ, নেপাল, ভুটান) এর প্রভাবের কারণে বাংলাদেশ এই প্রধান উৎপাদন কেন্দ্রগুলি থেকে আসা মাদকের ট্রানজিট রুট হিসেবে কাজ করে 1।বাংলাদেশের তিনটি প্রধান আন্তর্জাতিক মাদক করিডোরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান বোঝায় যে গাঁজা চোরাচালান কেবল ভারত বা মিয়ানমারের সাথে একটি দ্বিপাক্ষিক সমস্যা নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর, আন্তঃসংযুক্ত বৈশ্বিক অবৈধ বাণিজ্যের অংশ। এর অর্থ হলো, কার্যকর মাদকবিরোধী কৌশলগুলির জন্য কেবল নিকটবর্তী প্রতিবেশীদের বাইরেও বহুপাক্ষিক সহযোগিতা এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান প্রয়োজন, যাতে বৃহত্তর সরবরাহ শৃঙ্খলগুলি ব্যাহত করা যায়।৩.২ অভ্যন্তরীণ প্রবেশপথ এবং বিতরণ কেন্দ্রমাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি জরিপে বাংলাদেশের ৩০টি সীমান্ত জেলার ৩৮৯টি নির্দিষ্ট প্রবেশপথ চিহ্নিত করা হয়েছে 4। এটি কয়েকটি কেন্দ্রীভূত এলাকার পরিবর্তে প্রবেশপথগুলির একটি অত্যন্ত খণ্ডিত এবং ব্যাপক নেটওয়ার্কের ইঙ্গিত দেয়।প্রধান হটস্পট:
দিনাজপুর: সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রবেশপথ, ৪৩টি স্বতন্ত্র স্থান সহ চিহ্নিত করা হয়েছে 4। দিনাজপুর এবং এর আশেপাশের এলাকা যেমন জয়পুরহাট ও ফুলবাড়ীতে নিয়মিত বিজিবি ও পুলিশ অভিযান এবং গাঁজা জব্দ এর প্রমাণ দেয় 7।
ফেনী: ৩৮টি প্রবেশপথ সহ এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হটস্পট 4।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জেলা: ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, যশোর এবং খাগড়াছড়ি প্রতিটি জেলায় ২০টিরও বেশি চিহ্নিত প্রবেশপথ রয়েছে 4।
রেলওয়ে রুটে মাদকবিরোধী অভিযান বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে, যা মাদক ও সাধারণ চোরাচালানের জন্য রেললাইন ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয় 8। এটি একটি অভ্যন্তরীণ বিতরণ ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়।চিহ্নিত প্রবেশপথগুলির (৩০টি জেলা জুড়ে ৩৮৯টি) ব্যাপক সংখ্যা এবং বিস্তৃতি একটি অত্যন্ত বিকেন্দ্রীভূত এবং অভিযোজনক্ষম চোরাচালান অবকাঠামো প্রকাশ করে, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির জন্য কার্যকরভাবে সীমান্ত বন্ধ করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। এই “ছিদ্রযুক্ত সীমান্ত” 5 বোঝায় যে একটি স্থির, নির্দিষ্ট-পোস্ট সীমান্ত নিরাপত্তা কৌশল অপর্যাপ্ত; এই অসংখ্য, প্রায়শই পরিবর্তনশীল, প্রবেশপথগুলি চিহ্নিত ও ব্যাহত করার জন্য একটি গতিশীল, গোয়েন্দা-নির্ভর এবং সম্প্রদায়-সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজন।সারণী ১: প্রধান গাঁজা চোরাচালান হটস্পট এবং চিহ্নিত প্রবেশপথজেলাচিহ্নিত প্রবেশপথের সংখ্যাসক্রিয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাদিনাজপুর৪৩বিজিবি, পুলিশ, র‍্যাবফেনী৩৮বিজিবি, পুলিশ, র‍্যাবঠাকুরগাঁও২০+বিজিবি, পুলিশ, র‍্যাবনীলফামারী২০+বিজিবি, পুলিশ, র‍্যাবযশোর২০+বিজিবি, পুলিশ, র‍্যাবখাগড়াছড়ি২০+বিজিবি, পুলিশ, র‍্যাবদ্রষ্টব্য: এই সারণীটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জরিপ 4 এবং অন্যান্য অভিযানের তথ্য 7 থেকে সংগৃহীত।৪. গাঁজা চোরাচালান মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জ৪.১ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য কার্যপরিচালনার অসুবিধাচোরাচালানকারীরা সক্রিয়ভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিরোধ করে। অতীতে গরু পাচারকারীদের হাতে বিএসএফ কর্মীরা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে 9, যা মাদক চোরাচালানকারীরাও অনুকরণ করতে পারে। তারা অন্ধকারের সুযোগ এবং দুর্গম ভূখণ্ড ব্যবহার করে পালিয়ে যায় 9।বাংলাদেশের ৪,৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, যার বেশিরভাগই ছিদ্রযুক্ত, যা মাদকসহ বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য সহজে দেশে প্রবেশ করতে দেয় 5। এই বিশাল এবং প্রায়শই চ্যালেঞ্জিং ভূখণ্ডে ব্যাপক নজরদারি এবং প্রতিরোধ অত্যন্ত কঠিন করে তোলে। চোরাচালানকারীদের আক্রমণাত্মক কৌশল, প্রাকৃতিক পরিস্থিতি (অন্ধকার, ভূখণ্ড) তাদের কাজে লাগানো এবং ছিদ্রযুক্ত সীমান্তের বিশালতা একটি উল্লেখযোগ্য কার্যপরিচালনার অসামঞ্জস্য তৈরি করে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি একটি অত্যন্ত অভিযোজনক্ষম এবং ভৌগোলিকভাবে বিস্তৃত হুমকির প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হয়, যা ক্লান্তি এবং সম্পদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এর অর্থ হলো, কেবল আরও সম্পদ নয়, বরং আরও স্মার্ট মোতায়েন, উন্নত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং সম্ভবত এড়ানোর কৌশলগুলির মোকাবিলায় অ-প্রাণঘাতী প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রয়োজন।৪.২ সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতাএকটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক দলের কর্মী (ডিএনসি জরিপের ৩০% উত্তরদাতা 4) এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জড়িত থাকা। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকে অর্থ প্রদান ছাড়া স্থানীয়ভাবে মাদক ব্যবসা করা কঠিন 4। এটি একটি গভীর প্রোথিত দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয় যা পাচারকারীদের রক্ষা করে এবং মাদকবিরোধী প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে।সীমান্তবর্তী অঞ্চলে উচ্চ বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য স্থানীয়, প্রায়শই দুর্বল, জনগোষ্ঠীকে (ডিএনসি জরিপের ৪১% উত্তরদাতা 4) মাদক চোরাচালানে ঠেলে দেয়, কারণ এটি প্রচুর অবৈধ আয়ের সুযোগ দেয় 4। এটি নেটওয়ার্কগুলির জন্য সহজে নিয়োগযোগ্য জনবল তৈরি করে। রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক হতাশার এই আন্তঃসম্পর্কিত দিকগুলি কার্যকর মাদকবিরোধী প্রচেষ্টার জন্য একটি শক্তিশালী বাধা তৈরি করে, এমন একটি “গোপন সাম্রাজ্য” তৈরি করে যা সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর গভীরে প্রোথিত। এটি নির্দেশ করে যে মাদক চোরাচালান কেবল একটি আইন প্রয়োগকারী সমস্যা নয়, বরং এটি একটি শাসনব্যবস্থা এবং উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ। এই পদ্ধতিগত সমস্যাগুলি সমাধান না করা হলে, নেটওয়ার্কগুলি ভেঙে ফেলার প্রচেষ্টা “হুইল-এ-মোল” খেলার মতো হবে, যেখানে নতুন অভিনেতা ক্রমাগত আবির্ভূত হবে।৪.৩ আন্তঃসংস্থা সমন্বয়হীনতা এবং সম্পদের অভাবচোরাচালান বন্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতার বিষয়ে সংসদ সদস্যদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে 5। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ এবং র‍্যাবের মধ্যে আরও সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন যে যেখানে সমন্বয় নেই সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে 5, সমস্যাটির ধারাবাহিকতা ইঙ্গিত দেয় যে এটি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।কিছু পর্যবেক্ষক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, এটিকে বিডিআর বিদ্রোহের কারণে “মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়া” এবং এর “রাজনৈতিক ব্যবহার” এর ফল বলে মনে করেন 5। তারা বাংলাদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে বিএসএফ এবং নাসাকা বাহিনীর পদক্ষেপের মুখে বিজিবির কথিত নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করেন 5। এই ধারণা, সঠিক হোক বা না হোক, জনবিশ্বাস এবং আন্তঃসংস্থা মনোবলকে দুর্বল করতে পারে। পুলিশের এবং র‍্যাবের সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হলেও 13, সীমান্ত নজরদারি এবং মাদকবিরোধী অভিযানের জন্য নির্দিষ্ট সম্পদের অভাব পরোক্ষভাবে ছিদ্রযুক্ত সীমান্ত এবং মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলির দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে।আন্তঃসংস্থা সমন্বয়হীনতা এবং বিজিবির কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ, পাশাপাশি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ধারণা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার পদ্ধতিগত দুর্বলতা নির্দেশ করে। এই বিভাজন এবং আস্থার অভাব কার্যপরিচালনার ক্ষেত্রে শূন্যতা তৈরি করতে পারে যা চোরাচালানকারীরা কাজে লাগায়, যার ফলে “গোপন সাম্রাজ্য” নির্দিষ্ট এলাকায় তুলনামূলকভাবে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে। আন্তঃসংস্থা প্রোটোকল, কমান্ড কাঠামো এবং জবাবদিহিতা ব্যবস্থার একটি মৌলিক পর্যালোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি সীমান্ত বাহিনীতে জনবিশ্বাস এবং অভ্যন্তরীণ আস্থা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা প্রয়োজন।৫. আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রচেষ্টা এবং প্রভাব বিশ্লেষণ৫.১ মাদকবিরোধী অভিযানের সংক্ষিপ্ত বিবরণবর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), বাংলাদেশ পুলিশ (ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং রেলওয়ে পুলিশ সহ), র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) সক্রিয়ভাবে মাদকবিরোধী অভিযানে জড়িত 5। এই অভিযানগুলির মধ্যে নিয়মিত অভিযান, জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় মাদকবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন 11 এবং অভিযানগুলির নিয়মিত পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি অন্তর্ভুক্ত 7।মাদক অনুপ্রবেশ এবং অবৈধ ক্রয়-বিক্রয় রোধে সীমান্তবর্তী এলাকার সকল স্তরের জনগণকে সভা, সেমিনার এবং সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে 7। চিহ্নিত গডফাদারদের সামাজিকভাবে বয়কট করা এবং তাদের আইনের আওতায় আনার আহ্বানও জানানো হয়েছে 8।৫.২ গাঁজা জব্দ এবং গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যানআইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি নিয়মিতভাবে বিপুল পরিমাণ গাঁজা জব্দ করছে এবং মাদক পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করছে।উল্লেখযোগ্য জব্দ:
২০১৭ সালে ডিএনসি ৬৯,৯৮৯ কেজি গাঁজা উদ্ধার করেছে 1।
একই বছর (২০১৭) বিজিবি একাই ১৬,৩৫৭ কেজি গাঁজা জব্দ করেছে, যার মূল্য ১২১৭.৫৫ কোটি টাকা 5। এটি ২০১৬ সালের ১১৬১.৬৭ কোটি টাকার তুলনায় ৫৫.৮৮ কোটি টাকা বেশি ছিল 5।
সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিবি-গুলশান বিভাগ রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে ১০২ কেজি গাঁজাসহ দুই মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে, যার আনুমানিক মূল্য ২০ লাখ ৪০ হাজার টাকা 6।
২০১৯ সালের আগস্টে দিনাজপুর অঞ্চলে পুলিশ ৮ কেজি ৬২৫ গ্রাম গাঁজা, র‍্যাব ৬ কেজি এবং রেলওয়ে পুলিশ ২৫ গ্রাম গাঁজা জব্দ করেছে 8।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) মালদা সেক্টর থেকে ১ কেজি গাঁজা উদ্ধার করেছে, যা আন্তঃসীমান্ত প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয় 9।
গ্রেফতার:
২০১৭ সালে বিজিবি মাদক/চোরাচালানের অভিযোগে ২,৬৮৯ জন এবং অবৈধ সীমান্ত অতিক্রমের দায়ে ১,১১৪ জন বাংলাদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করে থানায় সোপর্দ করেছে 5।
২০১৮ সালের জুনে দিনাজপুর অঞ্চলে ৮ জন এবং ২০১৯ সালের আগস্টে ১৮ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে 7।
প্রবণতা:
মাসিক তুলনা (যেমন – ২০১৯ সালের জুলাই বনাম আগস্টে দিনাজপুর অঞ্চলে) অভিযান, গ্রেপ্তার এবং জব্দকৃত মূল্যের ওঠানামা দেখায় 8। সামগ্রিকভাবে, ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালে জব্দকৃত মূল্যের বৃদ্ধি হয় চোরাচালান বৃদ্ধি অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকারিতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয় 5।
যদিও জব্দ এবং গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যান আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সক্রিয় প্রচেষ্টার প্রমাণ দেয়, দেশে মাদকের ব্যাপক প্রবেশ (ধারাবাহিক বৃহৎ জব্দ দ্বারা প্রমাণিত) ইঙ্গিত করে যে বর্তমান প্রচেষ্টা, যদিও প্রশংসনীয়, মূলত প্রতিক্রিয়াশীল এবং মূল নেটওয়ার্কগুলিকে যথেষ্টভাবে ব্যাহত করতে বা নতুন প্রবেশকারীদের নিরুৎসাহিত করতে সক্ষম নয়। ওঠানামাকারী পরিসংখ্যানগুলি অভিযোজনক্ষম চোরাচালানকারীর আচরণ বা অসঙ্গত প্রয়োগের চাপ নির্দেশ করতে পারে, যা অবৈধ বাণিজ্যের একটি নির্দিষ্ট হ্রাস নয়। উচ্চ জব্দ একটি উল্লেখযোগ্য সরবরাহ এবং সক্রিয় প্রয়োগের ইঙ্গিত দেয়, কিন্তু মাদকের অব্যাহত ব্যাপক সহজলভ্যতা বোঝায় যে মাদকের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও ধরা পড়ছে না। এর অর্থ হলো, বর্তমান কৌশলগুলি কার্যপরিচালনার স্তরে (ব্যক্তিগত চালান/বাহক ধরা) কার্যকর হতে পারে, কিন্তু কৌশলগত স্তরে (পুরো নেটওয়ার্ক, বিশেষ করে গডফাদার এবং আর্থিক প্রবাহ ভেঙে ফেলা) কম কার্যকর। “গোপন সাম্রাজ্য” তার সরবরাহ পূরণ করে চলেছে, যা পরিমাণ-ভিত্তিক জব্দ থেকে নেটওয়ার্কের নেতৃত্ব এবং আর্থিক মেরুদণ্ডের গোয়েন্দা-নির্ভর ব্যাহত করার দিকে একটি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।সারণী ২: আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক গাঁজা জব্দ এবং গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যান (২০১৭-২০২৫)সময়কালসংস্থাগাঁজা জব্দ (কেজি)আনুমানিক মূল্য (টাকা)গ্রেপ্তার (সংখ্যা)২০১৭ডিএনসি৬৯,৯৮৯–২০১৭বিজিবি১৬,৩৫৭১২১৭.৫৫ কোটি২,৬৮৯ (মাদক/চোরাচালান)মার্চ ২০২৫বিজিবি-১৫২.০৮ কোটি-মে ২০২৫ডিএমপি১০২২০.৪০ লক্ষ২জুন ২০১৮বিজিবি-১.২৩ কোটি৮আগস্ট ২০১৯পুলিশ৮.৬২৫-২২৪ (মাদক মামলা)আগস্ট ২০১৯র‍্যাব৬–আগস্ট ২০১৯রেলওয়ে পুলিশ০.০২৫–জুলাই ২০১৯পুলিশ-৩১.৬৮ লক্ষ২২১ (মাদক মামলা)জুলাই ২০১৯বিজিবি-৯৩.২৫ লক্ষ১৮জুলাই ২০১৯পুলিশ–৩১৬ (মাদক মামলা)জুলাই ২০২০বিএসএফ১–দ্রষ্টব্য: এই সারণীটি বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্য 1 এবং গাঁজা-নির্দিষ্ট তথ্য যেখানে উপলব্ধ সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মূল্যের তথ্য প্রায়শই অন্যান্য চোরাচালান পণ্যের সাথে একত্রিত থাকে।৬. নীতি কাঠামো এবং কৌশলগত সুপারিশ৬.১ বিদ্যমান নীতিগুলির পর্যালোচনাবাংলাদেশ সরকার, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায়, মাদকের বিরুদ্ধে “জিরো টলারেন্স” নীতি গ্রহণ করেছে 17। এই নীতি মাদকাসক্তি এবং অবৈধ পাচার নির্মূলের লক্ষ্য রাখে। ১৯৯০ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) অবৈধ মাদকের প্রবাহ রোধের জন্য প্রধান সরকারি সংস্থা 18। এর মিশনের মধ্যে প্রয়োগকারী এবং আইনি কার্যক্রম জোরদার করা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা অন্তর্ভুক্ত 18। ডিএনসি’র মোট অনুমোদিত জনবল ৩০৬৯ জন 18 এবং এটি গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, অভিযান পরিচালনা, গ্রেপ্তার, তদন্ত এবং আইনি কার্যক্রমের জন্য দায়ী 18।সংশ্লিষ্ট আইনগুলির মধ্যে রয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ 18 এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ 19, পাশাপাশি লাইসেন্সিং, জব্দ ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র সম্পর্কিত বিভিন্ন বিধিমালা 19। সরকারি উদ্যোগগুলির মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন অন্তর্ভুক্ত 7। প্রতিরোধে পরিবার এবং সমাজের ভূমিকার গুরুত্বও স্বীকৃত 7।একটি শক্তিশালী নীতি কাঠামো এবং নিবেদিত সংস্থা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও, গাঁজা চোরাচালানের “গোপন সাম্রাজ্য” এর ধারাবাহিকতা এবং বৃদ্ধি নীতিগত উদ্দেশ্য এবং কার্যকর বাস্তবায়নের মধ্যে একটি ব্যবধানের ইঙ্গিত দেয়। “জিরো টলারেন্স” নীতিকে অবশ্যই মাঠে ধারাবাহিক, সমন্বিত এবং আপসহীন পদক্ষেপে রূপান্তরিত করতে হবে, বিশেষ করে প্রয়োগকে দুর্বল করে এমন সামাজিক-রাজনৈতিক কারণগুলি মোকাবিলায়। নীতি ও সংস্থার অস্তিত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আন্তঃসংস্থা সমন্বয় যেখানে দুর্বল, সেখানেই বাস্তবায়নে ঘাটতি দেখা যায়। “জিরো টলারেন্স” নীতি, যদিও বাগাড়ম্বরে শক্তিশালী, তাকে অবশ্যই প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির মধ্যেই দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রতি “জিরো টলারেন্স” পদ্ধতির সাথে মেলাতে হবে। এটি অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং জবাবদিহিতা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।৬.২ উন্নত সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির জন্য সুপারিশ৪,৭০০ কিলোমিটার ছিদ্রযুক্ত সীমান্ত 5 এবং চোরাচালানকারীদের অন্ধকার ব্যবহারের কারণে 9, উন্নত নজরদারি প্রযুক্তিতে (যেমন – নাইট ভিশন, ড্রোন, গ্রাউন্ড সেন্সর) বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভিযান বাড়ানো এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে 7। নেটওয়ার্কগুলির উপর ধারাবাহিক চাপ নিশ্চিত করতে এর ধারাবাহিক অনুসরণ প্রয়োজন। রেলওয়ে স্টেশনযুক্ত উপজেলাগুলিতে রেলপথে মাদকবিরোধী অভিযান বাড়াতে হবে, কারণ এগুলি সম্ভাব্য চোরাচালানের পদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে 8।শুধুমাত্র অভিযান বাড়ানো অপর্যাপ্ত; চোরাচালানকারীদের গতিবিধি অনুমান করে এবং সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে, গোয়েন্দা-নির্ভর, লক্ষ্যভিত্তিক নজরদারির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সীমান্তের বিশালতা সর্বাধিক কভারেজ এবং কার্যকারিতার জন্য মানব গোয়েন্দার সাথে প্রযুক্তির কৌশলগত মোতায়েনকে অপরিহার্য করে তোলে।৬.৩ নেটওয়ার্ক কাঠামো এবং আর্থিক প্রবাহ ব্যাহত করার জন্য সুপারিশ”গডফাদার” এবং হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক আর্থিক প্রক্রিয়াগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ 8। উন্নত অর্থ পাচার বিরোধী প্রয়োগ এবং মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন পর্যবেক্ষণ 11 এই নেটওয়ার্কগুলির আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পারে। উচ্চ লাভজনকতা এবং অনানুষ্ঠানিক আর্থিক চ্যানেলগুলি এই নেটওয়ার্কগুলিকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি দেয়। এই আর্থিক প্রবাহগুলিকে ব্যাহত করা নিম্ন-স্তরের অপারেটরদের গ্রেপ্তারের চেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারে, কারণ এটি নেটওয়ার্কের পুনর্গঠন ক্ষমতাকে আঘাত করবে।৬.৪ সামাজিক-রাজনৈতিক কারণগুলি মোকাবিলায় সুপারিশপ্রভাবশালী ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে শক্তিশালী দুর্নীতি দমন অভিযান 4 এবং সীমান্ত সম্প্রদায়গুলিতে টেকসই বিকল্প জীবিকা ও শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ 4 মাদক ব্যবসায় নতুন নিয়োগ রোধে সাহায্য করবে। রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক হতাশার এই আন্তঃসম্পর্কিত কারণগুলি মাদক চোরাচালানকে একটি পদ্ধতিগত সমস্যায় পরিণত করেছে। শুধুমাত্র শাস্তিমূলক পদ্ধতি ব্যর্থ হবে। একটি সামগ্রিক কৌশলে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে শক্তিশালী দুর্নীতি দমন অভিযান, পাশাপাশি সীমান্ত সম্প্রদায়গুলিতে টেকসই বিকল্প জীবিকা এবং শিক্ষার জন্য উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যাতে নিয়োগের চক্র ভেঙে যায়।৬.৫ আন্তঃসংস্থা সমন্বয় এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করার জন্য সুপারিশআন্তঃসংস্থা প্রোটোকল, ভাগ করা গোয়েন্দা প্ল্যাটফর্ম এবং বাহিনীর পেশাদারীকরণের একটি মৌলিক পর্যালোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ 5। মিয়ানমারের সাথে যৌথ টহল এবং লিয়াজোঁ অফিস স্থাপনের মাধ্যমে বহুপাক্ষিক সহযোগিতা জোরদার করা প্রয়োজন 20। আন্তঃসংস্থা সমন্বয়হীনতা এবং একটি মূল সীমান্ত বাহিনীর (বিজিবি) কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ নিরাপত্তা জালে “ফাঁক” তৈরি করে যা চোরাচালানকারীরা কাজে লাগায়। এটি বাধ্যতামূলক যৌথ অভিযান, ভাগ করা গোয়েন্দা প্ল্যাটফর্ম এবং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর পেশাদারীকরণ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার উপর শীর্ষ-ডাউন ম্যান্ডেটের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।৭. উপসংহারবাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে গাঁজা চোরাচালান একটি বহুমুখী এবং গভীরভাবে প্রোথিত সমস্যা যা দেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, আর্থ-সামাজিক দুর্বলতা এবং কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতার দ্বারা জটিল হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির নিয়মিত অভিযান এবং বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দ করা সত্ত্বেও, চোরাচালান নেটওয়ার্কগুলির অভিযোজন ক্ষমতা এবং তাদের ব্যবহৃত অনানুষ্ঠানিক আর্থিক প্রক্রিয়াগুলি তাদের স্থিতিস্থাপকতা প্রমাণ করে।এই “গোপন সাম্রাজ্য” মোকাবিলায় একটি সমন্বিত, বহু-মাত্রিক এবং টেকসই পদ্ধতির প্রয়োজন। এতে কেবল কঠোর সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি বৃদ্ধিই নয়, বরং নেটওয়ার্কের আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলের দরিদ্র ও কর্মসংস্থানহীন জনগোষ্ঠীর জন্য বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরি করাও অপরিহার্য। পাশাপাশি, আন্তঃসংস্থা সমন্বয়হীনতা দূর করা এবং প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা এই অবৈধ প্রবাহকে কার্যকরভাবে বন্ধ করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র একটি সামগ্রিক এবং দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমেই বাংলাদেশের সীমান্তকে মাদকের ছায়া-পথ থেকে মুক্ত করে একটি সুস্থ ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব।

Share the Post:

Related Posts

কোডিং জানলেই কি ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত? নাকি অন্য স্কিলও লাগবে?

“ভাই, কোডিং শিখলেই তো লাইফ সেট!” এই লাইনটা এখন টিনএজার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া, এমনকি অনেক পেশাজীবীর মুখে মুখে। ইউটিউবে সার্চ

Read More

সীমান্তের ছায়া-রাস্তায়: গাঁজার চোরাচালান নেটওয়ার্কের গোপন সাম্রাজ্য

সীমান্তের ছায়া-রাস্তায়: গাঁজার চোরাচালান নেটওয়ার্কের গোপন সাম্রাজ্য লেখা: Sick Monsters টিমসিরিজ: অন্ধকারে আলোর খোঁজ (পর্ব ২) সীমান্তে অস্ত্র নেই, কিন্তু

Read More

রেজিস্ট্রেশন করুন, অন্যথায় কি সেবা ব্যবহার করতে ব্যর্থ হবেন